নিঝুমদ্বীপের দিনগুলি – শোয়েব আকন্দ

১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ – রবিবার : ছোট্ট একটি দেশ। এখানেই মহান আল্লাহ কত নেয়ামত ছড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা আসলে খুঁজে নিতে জানি না। আর জানলেও সময় ও অর্থের অভাবে দুচোখ ভরে তা উপভোগ করতে পারিনা। তেমনি একটি জায়গা হলো নিঝুমদ্বীপ। নিঝুমদ্বীপ নোয়াখালী জেলার একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত। সেখানে যাওয়া কষ্টসাধ্য কিন্তু দূর্গম নয়। আগের তুলনায় অনেক বেশী পর্যটক এখন নিঝুমদ্বীপে যাতায়াত করছে আর শীতকালই হচ্ছে উপযুক্ত সময়। সুযোগ খুজছিলাম কিন্তু সাহস করে উঠতে পারিনি। একে তো নদীপথ তার উপর অনেক দূরের রাস্তা। পরিবার পরিজন ও ছোট্ট বাচ্চা কাচ্চা  নিয়ে এত দূরে যাবো কিনা ভাবতেছিলাম। মানুষের মুখে নেতিবাচক কথা শুনে মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু অবশেষে নিঝুমদ্বীপের মায়া ছাড়তে পারলাম না।

১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬ টায় এম ভি তাসরিফ-২ লঞ্চে উঠে পড়লাম। আমি, আমার স্ত্রী,  দুই বাচ্চা এবং এক ভাগ্নে সহ মোট ৫ জন। নৌকায় ভ্রমণ করেছি অনেক কিন্তু জীবনেও কোনোদিন লঞ্চে চড়িনি। সদরঘাট গিয়ে দেখি মানুষ আর মানুষ। জিগ্যেস করে করে লঞ্চ খুঁজে পেলাম। তাও ছিল মানুষে ঠাসা। বুঝতে পারলাম আগে কেবিন বুকিং না দিয়ে ভুল করেছি। হাতে গুনা ২-৩টি কেবিন খালি আছে মাত্র। তাড়াতাড়ি একটি ডাবল কেবিন নিয়ে নিলাম ১৮০০ টাকায়।  জীবনের প্রথমবার লঞ্চে কোথাও যাবো। মিক্স অনুভূতি ছিল। ৬ টায় লঞ্চ ছাড়লো। বারান্দার চেয়ারে বসেছিলাম সবাই। কেবিন বয় চা দিয়ে গেল। বাচ্চারা খুবই উত্তেজিত। ঘুরে ঘুরে লঞ্চ দেখতে লাগল। আমার স্ত্রীকে সমস্ত লঞ্চটি ঘুরে দেখালাম। শীতের রাত, হিমেল হাওয়া বইছে। বাইরে বেশিক্ষণ বসা যায়না। নদীর স্বচ্ছ জলে আলো ঝলমল লঞ্চের প্রতিচ্ছবি। সে এক মোহনীয় দৃশ্য।

লঞ্চে নামাজ আদায় করতে গিয়ে পরিচয় হলো হাতিয়ার একজন মুরুব্বীর সাথে। নিঝুমদ্বীপ যাচ্ছি শুনে তিনি তো রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ঐখানে কষ্ট করে গিয়ে কি দেখবেন? ঐখানে তো দেখার কিছু নেই। শুনে আমি নিরাশ হলাম বটে কিন্তু দমে গেলাম না। তারপর পরিচয় হলো হাতিয়ার এক মাদ্রাসার হুজুরের সাথে। তার মেয়ে মিরপুর ৬ নাম্বারে এক মাদ্রাসায় হিফজ করছে। এখন ছুটিতে বাড়ী নিয়ে যাচ্ছেন। তিনিও শুনে বললেন ঐখানে দেখার তেমন কিছু নেই। সব জেনে শুনে যাচ্ছি কিনা, কোথায় থাকবো ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে তিনি অভয় দিলেন এবং তার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন যদি সমস্যায় পড়েন তাহলে তাকে যেন ফোন দেই। অবশেষে আমাদের কেবিন বয় এসে খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল এবং  নিঝুমদ্বীপে যে কিছু নেই তার এক মহা ফিরিস্তি দাখিল করলো। জগন্নাথের ছাত্রদের সাথে সেও নাকি গিয়েছিল। আর পেপার পত্রিকায় আমরা যা দেখি সবি নাকি ভূয়া! হায় হায় বলে কি। না জেনে গেলে তাদের কথায় নিশ্চিত বিভ্রান্ত হতাম। তবে কিছুটা হতাশ হয়েছি বলতে হবে। আসলে তাদেরও দোষ নেই। নিঝুমদ্বীপের দর্শনীয় স্হানগুলো তারা চেনেন না। নামার বাজার গিয়েই হয়তো থেমে গেছেন। আর যারা ছোটকাল থেকে এগুলো দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন তাদের কাছে এগুলো হয়ত কিছুই না। তাদের কাছে ঢাকা শহরের উচু উচু দালান কোটা দেখবার মতো লাগবে। যানবাহনের জ্যাম দেখে তারা হয়তো বা তাজ্জব বনে যাবেন।

রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। লঞ্চের খাবার সুস্বাদু কিন্তু খাবারের দাম অনেক বেশি। যারা এই রুটে নিয়মিত যাতায়াত করেন তারা বাড়ি থেকেই খাবার নিয়ে আসেন। বাচ্চার ঘুমাচ্ছে। আমরাও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। চোখ মনে হয় একটু লেগেও গিয়েছিল। ঢেউয়ের কারণে ঘুম থেকেই টের পাচ্ছিলাম লঞ্চের দুলুনী। আমার স্ত্রী একটা ভীতুর ডিম, একটু দুলুনীতেই সে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ে। ভাবে এই বুঝি লঞ্চ ডুবলো! স্হানে স্হানে লঞ্চ থামছে আর যাত্রীদের শোরগোলে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে যার যার গন্তব্যে। একে তো শীতের রাত তার উপর তীব্র বাতাস। লঞ্চের বাইরে দাড়ানোই কষ্টকর। লঞ্চের দুতলায় নামাজের জায়গার এক পাশে একটি পাতলা কম্বল গায়ে ঘুমিয়ে আছে এক কিশোর। মানুষের কত কষ্ট এই দুনিয়ায়। মনটা কেঁদে উঠে কিন্তু কিছুই করার থাকে না মাঝে মাঝে।

শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাহির হয়ে দেখলাম আমরা মনপুরা পৌছে গেছি। মনপুরা ভোলা জেলার একটি উপজেলা। এরপরের ঘাটের নামই তমরুদ্দি ঘাট। তমরুদ্দি ঘাট আবার নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায় পড়েছে। ওখানেই আমরা নামবো। লঞ্চ আবার চলতে শুরু করলো। চারিদিকে পানি আর পানি ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। আবছা কুয়াশায় সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। তীর হারা এক সাগরে ভাসছি আমরা। হীমেল হাওয়া শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। মনে হয় যেন এক অজানার দেশে ভেসে চলেছি যুগ যুগান্তর ধরে। মনে ভয় জাগে আবার পুলকিত হই অজানাকে জানতে। মাঝে মাঝে ভাবি আর শিহরিত হই। এই মাঝ দরিয়ায় যদি ডুবে যায় লঞ্চ তবে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। হয়তো আমাদের কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। মিশে যাবো এই বাংলার মাটি আর পানির সাধে। ফজরের নামাজ আদায় করলাম লঞ্চের দুতলার প্রথম দিকের নির্দিষ্ট জায়গায়। অনেক শীত পড়েছে ভোরের দিকে।

১৭ ডিসেম্বর ২০১৮ – সোমবার : ভোর ৫টার কিছু পরেই লঞ্চ হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাটে পৌছল। যাত্রীরা নামতে শুরু করলো। নামার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। কেবিন বয় এসে রাতের খাবারের বিল ধরিয়ে দিলো। বিলের যোগফলে গন্ডগোল ছিল। অতঃপর লঞ্চ থেকে নেমে পড়লাম। আবার দেখা হলো মাদ্রাসার সেই হুজুরের সাথে। তার সাথে নাস্তা করলাম একটা হোটেলে। সিনজি ঠিক করলাম, মুক্তারিয়া ঘাট ১০০০ টাকা। রাস্তা কি যে খারাপ। কিন্তু কিচ্ছু করার নাই। সারারাত লঞ্চ জার্নির পর ট্রলারে উঠতে মন চাইলো না। তাছাড়া হাতিয়া এবং তার পরিবেশ প্রতিবেশ দেখারও একটা আগ্রহ ছিল। সারা রাস্তা যেমন তেমন, মুক্তারিয়া ঘাটের কাছাকাছি আগের রাস্তাটা ডাইলে চাইলে একাকার করার মতো অবস্থা। মনে হয় কৌটার ভিতর ঢুকাইয়া কে যেন আমাদের ঝালমুড়ি বানাইতেছে!

মুক্তারিয়া ঘাট নামলাম। ট্রলার নেই। স্পীড বোটে যেতে হবে। প্রতিজন ৬০ টাকা। সবাই উঠে বসলাম। ৫ মিনিটেই ক্রস করলাম বঙ্গোপসাগরের এই চ্যানেল। আমার ছেলে হতাশ। সে আরও কিছুক্ষণ স্পীডবোটে চড়তে চেয়েছিল। এই জায়গাটার নাম নিঝুমদ্বীপের বন্দরটিলা। এখন আমাদের যেতে হবে নামারবাজার। সেখানেই আমাদের থাকার জায়গা হাতিয়ার ডাকবাংলা যা নিঝুম রিসোর্ট নামে পরিচিত। প্রতি হোন্ডা ১২০ ও রিক্সায় ১৫০টাকা। ছেলেদের হোন্ডায় চাপিয়ে আমরা রিক্সা করে নামার বাজার নিঝুম রিসোর্টে পৌছলাম। বন্দরটিলা টূ নামারবাজার রাস্তার চুয়াখালি নামক জায়গাটির দৃশ্য খুবি মনোরম। এটি নিঝুমদ্বীপ বনায়নের ফলে সৃষ্ট একটি পরিকল্পিন বন। অনেক ভোরে গেলে এখানে নাকি হরিণ দেখতে পাওয়া যায়।

নিঝুম রিসোর্টের মালিক সবুজ ভাই একজন সজ্জন ব্যক্তি। তার মতো হেল্পফুল মানুষ আমি কমই দেখেছি। নিঝুম রিসোর্ট দেখতে আহামরি কিছু না। দ্বীপের অন্যান্য হোটেলের অবকাঠামো, দরজা ও বাথরুমের ফিটিংস এর চেয়ে অনেক ভাল। কিন্তু সেখানে সবুজ ভাই নামক লোকটি নেই। আমার ধারণা সবুজ ভাই নিঝুম রিসোর্টে না থাকলে এখানে পর্যটকের আনাগোনা কমে যাবে। আমাদের রুমটি ছিল দুতলায়। রুমটি সুন্দর করে সাজানো গোছানো। মেঝেতে প্লাস্টিকের ম্যাট বিছানো। আমরা রুমে ঢুকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার বের হলাম। রিসোর্টের কাছেই নামারবাজার মাত্র ২ মিনিটের রাস্তা। নিঝুমদ্বীপের রাজধানী বলতে পারেন এটিকে।

বাজারে গিয়ে আলতাফ চাচার হোটেলে নাস্তা খেলাম। সিদ্ধ আটার রুটি। ঠিকমতো স্যাঁকা হয়নি। মনে হয় কাচাই রয়ে গেছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন নয়। গ্রামের একটা হোটেল যেমন হয় আর কি। বেড়াতে বের হলে সব কিছুই মানিয়ে নিতে হয়। নামারবাজার থেকে পশ্চিম দিকে আলতাফ চাচার হোটেলের পাশের রাস্তাটিই সোজা চলে গেছে নামারবাজার সী বীচে। আমরা সেই রাস্তা ধরেই রওনা দিলাম। সাথে আমাদের ছোট্ট গাইড ‘আপন’। বয়স ৭-৮ বছর হবে। পিতৃহীন ছেলে। এই শীতে তার পরনে লুঙ্গি ও একটা পাতলা ছেড়া শার্ট। রাস্তার পাশেই খাল কিন্তু পানি নেই। নৌকার মেরামত চলছে খালে। সামনের বর্ষায় এসব নৌকা সাগরে মাছ ধরতে যাবে। থাকবে মাসাধিক কাল। রাস্তার পাশের খেজুড় গাছ চেঁছে রস আহরণের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এই রস থেকে তৈরী হবে সুস্বাদু খেজুরের গুড়।

 

আমরা হাটতে থাকলাম বীচের দিকে। বীচে গিয়ে আমাদের সারা রাতের ভ্রমণের ক্লান্তি মূহুর্তেই উবে গেল। বুঝলাম নিঝুমদ্বীপে আসা সার্থক হয়েছে। এমন নির্জন বীচ বাংলাদেশে আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। এখানে পর্যটক কম আসে সাধারণত দুরত্ব এবং খারাপ রাস্তার কারণে। আমার ছোট্র মেয়ে বালুতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল। আমার স্ত্রী বীচ ধরে সোজা হাটা দিয়েছে দিগন্তের পানে। এখানে তাঁবু খাটিয়ে কাটিয়ে দেয়া যায় সারাবেলা। অলস দুপুরে একটু নির্জনতায় বসে থাকতে মন চাইবে এই সাগরের বেলাভূমিতে। একেবারে অকৃত্রিম, মানুষের হাতের কোনো ছোয়া লাগেনি এখানে। আপনি যদি আমোদ প্রিয় হোন, হই হুল্লোড় করতে পছন্দ করেন কিংবা সমুদ্রে অবগাহন করার জন্যই সাগর দেখতে আসেন তাহলে বলবো এ জায়গা আপনার জন্য নয়। আপনার জন্য কক্সবাজারই উত্তম। এই জায়গাটি হলো তাদের জন্য যারা নির্জনতা পছন্দ করেন এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসেন।

ভাটার কারণে পানি বেশ দূরে সরে গেছে। কাদাতে চড়ে বেড়াচ্ছে অতিথি পাখির দল। দূরে দেখা যাচ্ছে কবিরাজের চর। কণ্যাকুমারিক সী বীচের খেজুড়গাছ গুলো যেন পাতা নেড়ে নেড়ে ডাকছে। কত সুন্দর এই বীচ তা লিখে বুঝানো যাবে না। এটি উপলদ্ধির বিষয়। এখানকার বীচের সমস্যা হলো কাদার জন্য গোসল করা যায় না এবং শীতকালে পানি অনেক দূরে সরে যায়। একেবারেই ঢেউ থাকে না তখন। ফাল্গুন-চৈত্র মাসের দিকে পানি বেশী থাকে এবং বড় বড় ঢেউ হয়। তখন সমুদ্রে অবগাহনের জন্য কুমারিক সী বীচই উপযুক্ত জায়গা। বেশ কিছুক্ষণ ছিলাম বীচে। হোটেলে ফিরে এসে গোসল সারলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে নৌকা দিয়ে যাবো কবিরাজের চর। তারপর কমলার বনে হরিণ দেখতে। নৌকা ঠিক হলো ২২০০ টাকায়। জাকির মাঝির নৌকা।

নামাজ আদায় করে চলে গেলাম নামারবাজার আলতাফ চাচার হোটেল। দুপুরের খাবার খাওয়ার পর হোটেলে ফিরলাম। খাবারের দাম এই সিজনে একটু বেশীই। বড় বড় ও ভাল ভাল মাছ ঢাকা এবং চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বর্ষায় গেলে মাছ সস্তা এবং খাবারের দামও তুলনামূলকভাবে কম থাকে। মাছ সস্তা হলেও নদী ও সাগরে থাকে বড় বড় ঢেউ আর কাদার ছড়াছড়ি। তাই শীতকালই নিঝুমদ্বীপ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। আমাদের নৌকা অপেক্ষা করছে। মাঝারি সাইজের নৌকা। নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের খাল ধরে এগিয়ে চলছে কবিরাজের চরের দিকে। মৃদুমন্দ ঢেউ ছিল নদীতে। নিম্নচাপের জন্য সাগরে তখন ২ নাম্বার সংকেত। আকাশ পরিস্কার ছিল তাই ভয় পেলাম না। তাছাড়া মাঝিরা বেশ অভিজ্ঞ। নৌকা নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের পাশের খাল দিয়ে মেঘনা নদীতে পড়েছে। শীতল হাওয়া বইছে। কবিরাজের চরের কাছে পৌছলাম কিন্তু নৌকা তীরে ভেড়াতে পারলো না ভাটার কারণে। অগত্যা নৌকা ঘুরিয়ে চলে গেলাম কমলার চরের দিকে।

বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটা চরের কাছে নৌকা ভেড়ালো মাঝিরা। স্হানীয় লোকজন একে বলে ‘আমার চর’। নেমে পড়লাম নৌকা থেকে। হাটু সমান পানিতে হেটে পৌছলাম চরে। কোনো কাদা নেই এখানে। বেশ শক্ত বেলে মাটি। দুপুরে যদি এখানে আসতাম তাহলে মনের মতো গোসল করতে পারতাম। সারা চর জুড়ে ঢেউয়ের আল্পনা আঁকা। খালি পায়ে হাঁটছি আর ঢেউয়ের কারণে সৃষ্ট বালির স্তূপগুলো পায়ের তলায় শক্ত অনুভূত হচ্ছে। দূরে চষে বেড়াচ্ছে অতিথি পাখির দল। কাছে গেলেই উড়ে চলে যায় চরের অপর প্রান্তে। কি যে সুন্দর লাগছিল বলে বুঝাতে পারবো না। নির্মল বায়ু, ঠান্ডা পানি। যেদিকে চোখ যায় কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘনা নদী আর সাগরের মিলন মেলা। বাতাস আর ঢেউয়ের শব্দ থেকে মনটা ফিরে যেতে চায় না। মন চায় দিনের বাকীটা সময় এখানেই কাটিয়ে দেই। আসলে এসব জায়গা হলো রিলাক্স করার জন্য। টাইট শিডিউল নিয়ে বেড়াতে গেলে কিছুই দেখা হয় না। যা হয় তা শুধুই ঘুরাঘুরি। এখানে এসে নির্জনতায় একটু বসার মতো সময় আমরা নিয়ে আসিনা। আসি শুধু হই হুল্লোড় করতে। যা সাময়িক আনন্দ দান করে বটে কিন্তু এতে আত্মার প্রশান্তি হয় না।

আবার নৌকায় উঠে বসলাম। এবার যাবো কমলার চর। এখান থেকে বেশ দূরে। সেখানের বনেও হরিণ ও কিছুসংখ্যক বন্য মহিষ আছে। ভাগ্য যদি ভাল হয় তাহলে হরিণের দেখা পেয়েও যেতে পারি। নদীতে ঢেউ একটু বেড়েছে। মাঝে মাঝে বেশ বড় ঢেউয়ের মুখোমুখি হচ্ছে নৌকা। মাঝি ভাই সেই ঢেউ কাটানোর জন্য নৌকা একটু এদিক সেদিক ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বেশ দক্ষ তাঁরা। আশে পাশের চরে অতিথি পাখির মেলা। এদের বেশীর ভাগই হাস প্রজাতির। মাঝে মাঝে বেশ বড় বড় বক জাতিয় পাখি দেখা যাচ্ছে। উঁচু নীচু অনেক চর জেগে উঠেছে মেঘনা নদীতে। এখানে কোনটা নদী আর কোনটা সাগর তা বুঝা মুশকিল। নদী সাগরে একাকার হয়ে আছে নিঝুমদ্বীপ। এটি মূলত একাধিক দ্বীপের সমষ্টি। ছোট বড় অনেক দ্বীপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে। পড়ন্ত বিকাল, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মন তাড়া দিচ্ছে কখন পৌছবো কমলার চরে। সাথে ছোট ছোট বাচ্চারা। দিনে দিনে হোটেলে ফিরতে পারলে ভাল হয়।

কমলার চরের কাছাকাছি চলে আসলাম। নৌকা তীরে ভিড়লো। বেশ উচু চর। কি পিচ্ছিল মাটি রে বাবা। আমরা একে অপরের হাত ধরাধরি করে চরে উঠলাম। একবার পিছলে পড়ে গেলে সোজা নদীতে গিয়ে পড়বো। আসলে এখানের চরগুলো নদীবিধৌত উর্বর পলি মাটি দ্বারা ঘটিত। আমার মেয়েটার মাটির হাড়ি পাতিল বানানোর বড় শখ। তার বায়না সে মাটি নিবে। ঐখান থেকে কিছু মাটি নিয়ে নিলাম আমরা। এটেল দূআঁশ মাটির কথা ছোটবেলায় পাঠ্য পুস্তকে পড়েছি। আজ নিজের হাতে পরখ করে দেখলাম। পিচ্ছিল আঁঠালো ঠিক যেন ময়দার খাম্বির। হাটা দিলাম বনের দিকে। এখানে বনের প্রকৃতি প্রায় সবি একই রকম। গেওয়া, কেওড়া আর এক ধরনের কাটাযুক্ত গাছের সমাহার। আর আছে বন জুড়ে কেওড়া গাছের শ্বাসমূল। খুব সাবধানে শ্বাসমূলের ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে হাটতে হয়। আমার মেয়েটা একবার পড়ে গিয়ে বেশ ব্যাথা পেয়েছে। আমরা হাটতে হাটতে বনের বেশ ভিতরে চলে গেলাম। পথে হরিণের পায়ের অসংখ্য ছাপ ও বিষ্টা দেখতে পেলাম। কিন্তু হরিণের দেখা পেলাম না। বাচ্চাদের মন খারাপ।

আসলে হরিণ দেখতে হলে ধৈর্য্যসহ নিঃশব্দে হাটতে হয়। একটু শব্দ হলেই উধাও হয়ে যায় হরিণের পাল। বাচ্চা কাচ্চা সাথে থাকলে হরিণের আশা ত্যাগ করতে হবে। সারা বন জুড়ে গাছের ডাল পালা গুলো নীচ থেকে এমনিভাবে ছাটানো যে দেখলে মনে হয় সেগুলো কেউ ছেটে রেখেছে। আসলে হরিণের দল গাছের পাতা এমনভাবে খেয়েছে যে দেখলে মনে হয় কেউ সুন্দর করে এক মাপে কেটে রেখেছে। ছেলেরা আরও ভিতরে ঢুকতে চাইলো কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্য সায় দিলাম না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এবার ফিরতে হবে। তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে পড়লাম। নৌকা ফিরে চলছে। আবার অবারিত জলরাশি। অতিথি পাখির মেলা। ঢেউয়ের দোলায় দুলছে নৌকা। জোয়ার থাকাতে নৌকা একটু তাড়াতাড়ি চলছিল। আমরা কবিরাজের চরের কাছাকাছি চলে এসেছি। অন্ধকার ঘনিয়ে এল। আলো আর আঁধারে একাকার হয়ে গেছে নদী আর বনরাজি। সে এক অপার্থিব দৃশ্য। মনে হচ্ছে কোনো এক অজানা রাজ্যে এসে পড়েছি আমরা। ভূলে গেছি নগর জীবনের যত ক্লেশ।

হঠাৎ করে নৌকা বন্ধ হয়ে গেল। মাঝি বলল মবিল নেই। আমরা তখন চৌধুরী খালের অপর প্রান্তে। মাঝিদের একজন চলে গেল কাছেই নোঙর করা আরেকটি নৌকা আনতে। আমরা চিন্তা করলাম নৌকায় বসে থেকে কি হবে নেমে পড়ি। মাঝিভাই সিড়ি নামিয়ে দিলো। হাটু সমান কাদায় আমরা নেমে পড়লাম। সে কি রে কাদা একেবারে ক্রিমের মতো হাটু পর্যন্ত লেপ্টে আছে। মাঝিভাই বালতি করে পানি নিয়ে এলো। পা ধুয়ে চরের উপর দিয়ে খালি পায়ে হাটতে লাগলাম। নৌকা থেকে দেখেছিলাম চরে কচি ঘাস উঠেছে। এই ঘাস এখন পায়ের তলায় সুইয়ের মতো ফুটছে। আরে বাবা কচি ঘাসও এতো শক্ত! বেশিক্ষণ হাটতে হলো না। যে মাঝি নৌকা আনতে গেছিল সে আরেকটি নৌকা নিয়ে ফিরে এসেছে। ঐ নৌকায় আরও পর্যটক ছিল। আমরা তাতে উঠে বসলাম। এসব জায়গায় মহিলা ও বাচ্চাদের নিয়ে নৌকায় চড়াও একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। কিছুক্ষণ চলার পর নৌকা আমাদের নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের পাশের খালের একটি নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে দিলো। আমরা সামান্য হেটে নিঝুম রিসোর্টে ফিরে গেলাম।

মাগরিবের নামাজের পর আমরা নামারবাজার হাটতে গেলাম। বাজার তখন জমে উঠেছে। নামারবাজার সারাদিনই খোলা থাকে কিন্তু সকালের চেয়ে রাতের বেলায় বেশি জমে উঠে। সারাদিনের কাজের পর দ্বীপবাসী মানুষেরা এখানে এসে মিলিত হয়। বাজার করে, আড্ডা মারে। আমরা একটি দোকানে বসে চা পান করলাম এবং আমাদের গাইড আপনের জন্য কিছু কেনাকাটা করে রিসোর্টে ফিরে এলাম। রাতে আমরা সবুজ ভাইয়ের রান্না করা চিকেন বার-বি-কিউ খাবো। নিঝুমদ্বীপে একমাত্র তার কাছেই সমস্ত যন্ত্রপাতি ও মশলা আছে। অন্যান্য হোটেল থেকে পর্যটকেরা এখানে এসে তার হাতের বার-বি-কিউ খায়। বলতে পারেন তিনি এটির উস্তাদ। চুয়াখালী যাওয়ার হোন্ডা আসবে সকাল ৬টায়। তাই দেরি না করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তির পর রাতে ভালো ঘুম হলো।

১৮ ডিসেম্বর ২০১৮ – মঙ্গলবার : ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়লাম। হোন্ডাচালকদের দেখা নাই। অপেক্ষা করতে লাগলাম। অবশেষে তারা এলো। আমরা হোন্ডায় চড়ে চুয়াখালীর দিকে ছুটে চললাম। কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকাল। তারা আমাদের এক সাবেক মেম্বরের বাড়িতে নিয়ে গেলো। গাছ থেকে পেরে খেজুরের রস খেলাম আমরা। আলহামদুলিল্লাহ। অনেক বছর পর খেজুরের রস খেলাম। বড়ই শান্তি পেলাম। নিঝুমদ্বীপে খেজুরের গুড়ের লুসা মানে লিকুইড খেজুরের গুড় পাওয়া যায়। এই বাড়িতেই আছে। তিন কেজি গুড় কিনলাম, ফেরার পথে নিয়ে যাবো। এরপর হরিণ দেখার জন্য খেত খামারের ভিতর দিয়ে রওনা দিলাম। বনে ঢুকে হাটতে লাগলাম। ঘন বন শ্বাসমূলে ভরা। সাবধানে পা ফেলে ফেলে হাটছি। চারিদিকে সুনসান নীরবতা মাঝে মাঝে পাখির কলকাকলি। এই বনটা অন্যান্য বনের তুলনায় একটু নিবিড় মনে হয়েছে। হটাৎ করে সামনে দেখলাম দুটি শিয়াল বসে রয়েছে। এত বড় শিয়াল দেখিনি কোনো দিন। আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেসব শিয়াল দেখেছি তা আকারে এত বড় ছিল না। এখানের শিয়ালগুলো নেকড়ের মতো বড়। প্রথমে তো দেখে মনে হয়েছিল নেকড়ে! বাঘ নেই তো কি হয়েছে শিয়ালই তাদের দায়িত্ব পালন করছে। হরিণ ধরে ধরে খাচ্ছে। তাইতো এতো নাদুস নুদুস শরীর। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে শরীর দুলিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে তারা প্রস্থান করলো।

আমরা আরো সামনের দিকে হাটতে লাগলাম। হোন্ডাচালক ছেলেটি অনেক চেষ্টা করেও আমাদের হরিণ দেখাতে পারলো না। পা বলছে এবার ফেরা যাক কিন্তু মন বলছে আরেকটু থাকি না। ফেরার কথা বলতেই আমার ছেলের মন খারাপ। হরিণ না দেখে সে যাবে না। ফেরার পথে হাটতে লাগলাম এবং একসময় মেম্বরের বাড়ীতে পৌছে গেলাম। এবার আমাদের যাত্রা চুয়াখালী বনের ভেতরে অবস্থিত পাতার পুকুরে। ঐখানে হরিণের দল নাকি পানি খেতে আসে। কিছুক্ষণ হোন্ডায় যাওয়ার পর বনের ভিতর দিয়ে পায়ে হাটা পথ ধরে এগুতে হবে। তবে এখানে শ্বাসমূলের আধিক্য কম। এখানকার গাছের মধ্যে গেওয়া ও বাইন গাছ বেশী হওয়াতে শ্বাসমূল কম। ছোট ছোট দুটি খাল পার হয়ে সামনে পড়লো এক বড় খাল। শুধু একটিমাত্র গাছ দেয়া এটিতে।  হাতে ধরার মতো কোনো ব্যবস্থাই নেই। থাকবেই বা কেন? পাড় হবো তো পা দিয়ে। হাত দিয়ে তো আর পাড় হবো না! তাই ব্যবস্থাও নেই। এখানে যারা খাল পাড় হয় তারা তাদের হাত এপাড়ে রেখে যায়! যাহোক ছেলেরা পাড় হয়ে গেলো কিন্তু বিপত্তি হলো আমার স্ত্রীকে নিয়ে। সে কোনোক্রমেই পাড় হতে পারলো না। এই বনের মধ্যে তাকে একা ফেলে আমরাও গেলাম না। আমাদের হরিণ দেখাও হলো না। ফেরার পথে আমার মেয়েটি ছাগল ছানা দেখতে পেয়েই ভারী খুশি। যদি খুশি হওয়ার মতো মন থাকে তাহলে সামান্য কিছু দেখেই খুশি হওয়া যায়।

এবার আমাদের যাত্রা নিঝুমদ্বীপ বন্দরটিলা। এটি মূলত একটি বাজার। সকালের বাজার বসেছে মাত্র। বেশীর ভাগ মাছই সামদ্রিক। তাজা চিংড়ি মাছ মাত্র ১২০ টাকা কেজি। ঢাকায় কিনতে গেলে আপনি নিজেই এর দাম বলবেন ৪০০ টাকা। আমার স্ত্রী বলছে কিনে লও। রান্নার ব্যবস্থা থাকলে কিনে রান্না করে খেতাম। সে আশায় গুড়ে বালি। বন্দরটিলা থেকে একটি রাস্তা চলে গেছে মেঘনা নদীর পাড়ে। চারদিকে ধানক্ষেত। শান্ত সৌম্য মেঘনা নদী। ইলিশ ধরার জন্য জালের পর জাল বিছিয়ে রেখেছে জেলেরা। তবে এখানে দেখার মতো আছে শুধু মেঘনা নদী। এবার বাজারে ফিরে এলাম। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। বন্দরটিলার একটি হোটেলে ঢুকলাম। কোনোমতে নাস্তা করলাম। গ্রামের বাজার, হোটেল আছে এটাই যথেষ্ট। না থাকলে উপোস থাকতে হতো। খারাপ হলেও পেটে তো কিছু দিতে পারলাম।

ফেরার পথে অর্ডার করা গুড় নিয়ে আমরা চলে এলাম কণ্যাকুমারিকা সী বীচ। এই সী বীচটি দেখার মতো একটা জায়গা বটে। এখানের সাগরে এই ডিসেম্বরে ঢেউ থাকে না। ঢেউ হয় ফাল্গুন চৈত্র মাসে। নিঝুমদ্বীপে শুধুমাত্র এই বীচটাতেই বালি থাকাতে এখানে গোসল করা যায়। আর কোথাও কাদার জন্য সাগরে নামাই যায় না। বীচের একপাশে খেজুড়ের একটি ছোট্ট বাগান। এখানে বসে ছিলাম কিছুক্ষণ। অতঃপর সাগরের বীচ ধরে হাটতে লাগলাম। পথের মধ্যে জুটে গেল ১০-১২ বছরের দুটি ছেলে। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম এই বীচ দিয়ে হাটতে হাটতে নামারবাজার সী বীচে যাওয়া যায়। অথচ হোন্ডাচালক ছেলেটি আমাদের বলেছিল যাওয়া যায় না। বুঝলাম গোমড় ফাস করলে তার ক্ষতি। ইনকাম কমে যাবে। দ্বীপের প্রত্যেক বীচেই অতিথি পাখির মেলা। কুমারিকা বীচের পাখিগুলো ফ্ল্যামিম্গো টাইপের পাখি। বেশ বড় বড় ঠোঁট। আমরা হাটতে হাটতে চলে এলাম নামারবাজার বীচে। ফোন করলাম এবং হোন্ডাচালক ছেলেটি এসে আমাদের নিয়ে রিসোর্টে পৌছে দিল। ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২ পর্যন্ত তারা দুজন আমাদের সাথে ছিল। দূই হোন্ডার ভাড়া দিলাম ১২০০ টাকা।

রিসোর্টের ম্যানেজার সবুজ ভাই বললেন, সকালে নাকি হরিণ এসেছিল রিসোর্টের পাশের রাস্তায়। আমরা তাজ্জব বনে গেলাম। আমরা হরিণ দেখতে বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আর হরিণ বেড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়! পরে জানতে পারলাম যে, নিঝুমদ্বীপ ফরেস্ট অফিস সংলগ্ন বনে তিন চারটি হরিণ থাকে। তারা সাধারণত খাল পার হয়ে মূল বনে যায় না। এরা মানুষকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছে। তাই মানুষকে ভয় পায় না। তাদের দেয়া ভাত তরকারী ও চিপস খায়। চিপস হরিণের অনেক প্রিয়। বাচ্চারা ছুটলো হরিণ দেখতে। আমাকেও তাদের পেছন পেছন ছুটতে হলো। উদ্যানের পাশের খালের পাশে মাঝিরা যেখানে নৌকা মেরামত করে সেখানেই হরিণটিকে পাওয়া গেল। স্বাস্হ্য বেশ ভাল। সুঠাম গড়ন। বাচ্চারা ছবি উঠালো এটিকে ধরে। ঠিক ধরা যায় না। শরীরে বেশ শক্তি। ধরতে গেলে কামড় দেয়। আমাদের সাথে চিপস ছিল না। আমার মেয়েটি পীড়াপিড়ি শুরু করলো চিপসের জন্য। বাজার দূরে কে যাবে চিপস আনতে। এক সময় হরিণটি বনের ভিতর চলে গেলো। আমরাও হোটেলে ফিরে এলাম।

গোসল ও খাওয়া দাওয়া সেরে বিকাল ৩টার দিকে তাঁবু নিয়ে রওনা হলাম কুমারিকা বীচের উদ্দেশ্যে। এবার আমরা হেটে যাবো। ঐখানে তাঁবু খাটিয়ে বিকালটা কাটিয়ে দিবো সাগর পাড়ে। নিম্নচাপটা তখনও বিদ্যমান। ঢাকায় নাকি সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। নিঝুমদ্বীপের আকাশ তখন হাল্কা মেঘে ঢাকা। আমরা নামার বাজার সী বীচ ধরে হাটা দিলাম কুমারিকা বীচের উদ্দেশ্যে। সাথে আমাদের নতুন গাইড আকরাম। যতই হাটছি আকাশের মেঘ ততই ঘনীভূত হচ্ছে। বাতাসের গতিবেগও বাড়ছে। আমরা চলে এসেছি কুমারিকা বীচে। এবার তাঁবু টানানোর পালা। আকাশ কালো হয়ে আসছে। বাতাসের বেগ আরও বেড়ে গেছে। মনে হচ্চে ঝড় আসবে। আমার স্ত্রী বললো তাবুটি বীচের কাছাকাছি না টানিয়ে কুমারিকা বীচের নিকটে খেজুরগাছ পরিবেষ্টিত বাড়ীর খেজুর গাছের নীচে টানাতে। বাড়তি সতর্কতার জন্য তাবুটি খেজুর গাছের সাথে বেঁধে দিলাম। যাতে বাতাসে উড়ে না যায়।

বাড়ীর কর্তা একজন গাছী। তিনি খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করে তা থেকে খেজুরের লিকুইড গুড় তৈরী করেন। নদী ভাঙা মানুষ। কে একজন তাদেরকে এ বাড়ীতে থাকতে দিয়েছে। সকালে যখন বীচ দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখেছিলাম তিনি গাছ চাঁচছেন। সারা শরীরে তার ক্লান্তির ছাপ। কত পরিশ্রম করে দ্বীপের মানুষ। আমরা তার কাছ থেকে ১৩ কেজির মতো খেজুরের লুসা (লিকুইড) গুড় কিনে নিলাম। না করা সত্বেও তাঁবু টানাতে তিনিও হাত লাগালেন। দ্বীপের মানুষগুলো এমনিই হয়। সহজ সরল পরিশ্রমী। আপনার বিপদে দেখবেন তারাই দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছে সবার আগে। তাঁদেরকে সম্মান করবেন। তাঁরাই এদেশের সত্যিকারের বীর।

বাচ্চারা বাড়ীর আঙ্গিনায় খেলায় মত্ত। দ্বীপের লোকজন ধার্মিক। মহিলারা পর্দানশীন। ৪ দিনেও কোনো যুবতী মেয়েকে আমি রাস্তায় দেখিনি। আসরের নামাজ পড়লাম তাবুতে। একটু পরেই শুরু হলো দমকা বাতাস আর বৃষ্টি। আমরা সবাই তাঁবুতে আশ্রয় নিলাম। সাথে গ্রামের কিছু ছেলেমেয়েরাও এসে জুটলো। আসলে তারা তারা এসেছে তাঁবু দেখতে। তাদের চোখে মুখে সে কি আনন্দ তাবুতে ঢুকতে পেরে। তারা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের মতো তাবুটিকে দেখতে লাগল। দু একজন পর্যটক যারা ঘুরতে এসে বৃষ্টির কবলে পড়লো তারাও এসে আশ্রয় নিলো। ১৫-২০ মিনিট পর বৃষ্টি থেমে গেলো। দূরের মসজিদে মাগরিবের আজান হচ্ছে। যে যার মতো চলে গেলো। আমরা তাড়াতাড়ি নামাজ পড়ে নিলাম। এবার শীত জেঁকে বসেছে, সাথে ঠান্ডা বাতাস। শরীর যেনো বরফ হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি তাঁবু গুটিয়ে নিলাম। কুমারিকা বীচ ধরে সোজা নামারবাজার বীচের দিকে হাটতে লাগলাম।

আকাশের মেঘ কেটে গেছে। মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো চাঁদ। আজ তো পূর্ণিমা না, কিন্তু চাঁদটাকে তারপরও বেশ বড় দেখাচ্ছে। চারিদিক চাঁদের আলোয় ধবধব করছে। সে এক অপার্থিব দৃশ্য। চিক চিক করছে সৈকতের বালিচর। আমরা হেটে চলেছি সৈকত ধরে। আমার ছেলে বলল, আব্বা, সী বীচে না তোমার জোছনা দেখার সাধ ছিল, আল্লাহ তা পূরণ করে দিলেন। মন চায় না হোটেলে ফিরতে তারপরও হেটে চলেছি। এই জায়গাটি ক্যাম্পিং করার জন্য উপযুক্ত জায়গা বটে। দ্বীপে যদিও নিরাপত্তার দিকে কোনো সমস্যা নেই তারপরও ফ্যামিলি ও বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ক্যাম্পিং করতে ভয়ভয় লাগে। একে তো দ্বীপ তার উপর এখানে কোনো টুরিষ্ট পুলিশ নেই। থাকতে হবে নিজ দায়িত্বে। ইয়াং ছেলেপুলেদের জন্য কোনো সমস্যা নেই। নিঝুমদ্বীপে বহু জায়গা আছে ক্যাম্পিং করার জন্য। বাজার কাছে থাকায় নামারবাজার সী বীচ সর্বোত্তম। তাছাড়া কন্যাকুমারিক বীচ, চৌধুরী খালের তীরে নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের সবুজ শ্যামল বিশাল মাঠটিও হতে পারে উপযুক্ত জায়গা। এখানে রাতে শুনতে পাবেন শিয়ালের হুক্কাহূয়া আর ভাগ্য যদি ভাল থাকে তাহলে খুব ভোরে দেখা হয়ে যেতে পারে হরিণের পালের সাথ।

আমাদের ছোট্ট গাইড আকরাম কাঁপতে কাঁপতে আমাদেরকে গ্রামের ভিতর দিয়ে নামারবাজার থেকে সী বীচ যাওয়ার রাস্তার মাঝামাঝি নিয়ে এলো। অনেকটুকু পথ হাটা থেকে বাচলাম। নিঝুমদ্বীপে ছোট ছোট ছেলেরা গাইডের কাজ করে। এসব জায়গা তাদের নখ দর্পনে। তার বেশ পটু। পারিশ্রমিক হিসাবে আপনি খুশি হয়ে যা দিবেন, হাসিমুখে নিবে। দুটো ছেলে সারাদিন আমাদের সাথে ছিল। আমরা যা খাইছি তাদের সাথে শেয়ার করেছি এবং সন্ধ্যায় এক দুশো করে টাকা দিয়েছি। তারা খুশি হয়ে ঘরে ফিরে গেছে। আমরা নামারবাজার হয়ে রিসোর্টে ফিরে এলাম। লম্বা হাটা হয়েছে। সবাই রুমে গিয়ে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়।

১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ – বুধবার : আজকেই শেষদিন নিঝুমদ্বীপে তাই  তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলাম। সবাইকে নিয়ে চলে গেলাম নামারবাজার সী বীচে। শীতের সকাল। সৈকতে আলো আঁধারের খেলা। সূর্য পূর্ব আকাশে সবেমাত্র উঁকি দিয়েছে। আমার স্ত্রী সোজা সৈকত ধরে হাটা দিয়েছে নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের দিকে। এমন খোলা প্রান্তর কোথায় পাই আমরা। কিংবা এই ভোরের বাতাস। বছরের একটা সময় কিছুদিন ছূটি পাই। তাই স্ত্রী সন্তান নিয়ে বেড়িয়ে যাই অজানাকে জানতে, অদেখাকে দেখতে। বাচ্চারা এই সময়টাকে কি যে উপভোগ করে এর মূল্য অসীম। কোনো কিছুকেই এর সাথে তুলনা করা চলে না। আমরা হাটতে হাটতে বীচের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে আসলাম। এখান থেকে চৌধুরী খালের নীল জলরাশি ও কবিরাজের চর দেখা যায়। নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের খাল দিয়ে জাকির ভাইয়ের নৌকা এক দল পর্যটক নিয়ে ছুটে চলেছে হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাটে। এই খালটাই মূলত নামারবাজার বীচ ও নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানকে আলাদা করে দিয়েছে। চৌধুরী খালের তীরে এবং জাতীয় উদ্যানের মাঝ বরাবর সবুজ গালিচার মতো এক বিশাল মাঠ। এটাকেই বলে চৌধুরী খালের মাঠ। এখানে খুব ভোরে এবং সন্ধ্যার আগে হরিণের পাল চড়ে বেড়ায়।

আমরা অনেক হাটাহাটি করলাম। বাচ্চারা গোসল করতে চায়। এই শীত ও কাদায় নদীতে নামতে দিতে সাহস পেলাম না। আমার মেয়েটা ঝিনুক কুড়াতে মহাব্যস্ত। আমাকে সাথে নিয়ে সে এগুলো নদীর পানিতে ধুয়ে নিয়ে আসলো। বাচ্চাদের কত বায়না। দুজন ফটোগ্রাফারকে দেখলাম হাটু সমান কাদায় দাড়িয়ে পাখির ছবি তুলেই চলেছেন। তারা কোনো এক বিদেশী সংস্থা থেকে এসেছেন। প্রতিবছরই তারা নিঝুমদ্বীপের বিভিন্ন চর ও বনে পাখির ছবি তুলে বেড়ান। দমার চর, আমার চর, কবিরাজের চর, কমলার চর, বিভিন্ন চরের মিলনমেলা এই নিঝুমদ্বীপ। এখানে চলছে ভাঙ্গা গড়ার খেলা। এ চর ভাঙ্গে তো ঐ চর গড়ে। বৈষ্যিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে যেভাবে সী লেভেল বেড়ে চলেছে। এই নিঝুমদ্বীপের অস্তিত্ব একসময় টিকে থাকবে কিনা আল্লাহই ভাল জানেন।

এবার বীচ থেকে ফেরার পালা। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে চলাফেরা করা অনেক ঝামেলা। তাদেরকে বার বার ডাকতে হয়। ওরা এটা কুড়ায় ওটা কুড়ায়। পেছনে পরে থাকে। এটাই তো শিশুদের স্বভাব। আর এই জন্যই ওরা শিশু। এবার আমরা বীচের পাশ দিয়ে গ্রামের দিকে চলে যাওয়া রাস্তা দিয়ে ফিরবো। উদ্দেশ্য গ্রামের ভেতরের অংশটা দেখা। রাস্তা দিয়ে ফেরার পথে পড়ল একটা টিনের মসজিদ। পাশেই একটা চায়ের দোকান। দোকানী একজন বৃদ্ধ লোক। দোকানে বসে চা পান করলাম। পাকা কলার ছড়ি ঝুলছে। গ্রামের দোকান যেমন হয়। দোকানীর বাড়ী নিঝুমদ্বীপে নয়। তিনি এসেছেন হাতিয়া থেকে। আল্লাহ যেখানে যার জীবিকা রেখেছেন। সেখানে তাকে যেতেই হবে।

হাটতে হাটতে হোটেলে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম এবং নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের জন্য বেড়িয়ে পড়লাম। বাচ্চারা জাতীয় উদ্যানের প্রথমেই অবস্থিত ওয়াচ টাওয়ারে উঠে নিঝুমদ্বীপের চারিদিক দেখে নিলো। অনেক উচু থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। নিঝুমদ্বীপে এলে অনেক হাটাহাটি করতে হয়। পেটে ক্ষুধার তাড়নাও তখন বেড়ে যায়। তাই সাথে কিছু নাস্তা নিয়ে নিলাম। আমরা যাবো নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের ভিতর দিয়ে চৌধুরী খালের পাড়ে’র সেই বিশাল সবুজ মাঠটায়। যা কিছুক্ষণ আগে নামারবাজার বীচ থেকে আমরা দেখেছিলাম। প্রথমে বড় খালটা পার হলাম। জাকির ভাইয়ের ছোট ভাই আমাদের সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন। নিঝুমদ্বীপে আমরা মূলত জাকির ভাইয়ের নৌকা করেই বেড়িয়েছি। লোকটাও ভাল। আসলে নিঝুমদ্বীপের মানুষের সাথে যদি আগ বাড়িয়ে মিশে যেতে পারেন তাহলে দেখবেন তারা আপনাকে আপন করে নিয়েছে।

এটাই হলো নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যান। গাছগুলো পরিকল্পিতভাবে লাগানো হয়েছে। বনের মাঝ বরাবর চলে গেছে ইটের সলিং রাস্তা। ঐ রাস্তা ধরে আমরা হাটতে লাগলাম। প্রথমেই পড়লো গেওয়া গাছের বন। বনের বেশীরভাগ গাছই গেওয়া ও কেওড়া। তবে বনে সুন্দুরী গাছের কিছু কিছু চারা সুন্দরবন থেকে এনে রুপণ করা হয়েছে। আর ছোট্ট খালের দুই পাড়ে লাগানো হয়েছে গোলপাতা গাছ। সুন্দরবনের ভূপ্রকৃতি আর নিঝুমদ্বীপ কিংবা কুয়াকাটা বনের ভূপ্রকৃতি প্রায় একই রকম। বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর চৌধুরী খালের পাড়ে সেই বিশাল মাঠটা গাছের ফাকে দিয়ে দেখতে পেলাম। এবার আমরা পৌছে গেলাম সেই মাঠে। বিশাল এক সবুজ মাঠ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় এখানে সবুজের গালিচা পেতে রেখেছেন মহান স্রষ্টা। দূরে চৌধুরী খাল তথা মেঘনা নদীর বিশাল জলরাশি ধোয়াটে দেখাচ্ছে। তার তীরেই এই বিশাল সবুজ মাঠ। মাঠের অপর প্রান্তে নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যান। বনটাও বিশাল এলাকা জুড়ে। বনের শেষ প্রান্তরেখা দূর নীলিমায় মিশে গেছে। ঠান্ডা হীম শীতল বাতাস হেটে আসার সমস্ত ক্লান্তি মূহুর্তেই দুর করে দিলো। বাচ্চারা ঘাসের উপর বসে পড়লো। আমরা সবুজ ঘাসের মাঠে কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নিলাম। আহ! কি শান্তি রে ভাই। এরপর হাটতে লাগলাম চৌধুরী খালের পানে। দূরে একদল মহিষের পাল বনের ভিতর ও বাইরের মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে। এগুলো বুনো মহিষ নয়। রাখালেরা মহিষের পাল নিয়ে দিনের পর দিন পড়ে থাকে এই বনে। এই ভর দুপুরে শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক ভেসে আসলো কানে। মনে হলো কাছেই কোথাও তারা হরিণের পালের পিছনে হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে।

নিঝুমদ্বীপে আগে অনেক হরিণ ছিলো। হরিণের সংখ্যা আশঙ্খাজনক হারে কমে গেছে। ধূর্ত শেয়াল হরিণের বাচ্চা খেয়ে ফেলছে। গ্রামের মানুষের ক্ষেত খামার নষ্ট করার কারণে গ্রামের মানুষও হরিণ চোরাকারবারীদের সাহায্যে হরিণ ধরে বিক্রি করেছে। বনবিভাগের উদাসীনতা ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের অভাবও এর জন্য দায়ী। অনেকক্ষণ ছিলাম চৌধুরী খালের মাঠে। এই জায়গাটিও ক্যাম্পিং এর জন্য একটা পছন্দসই স্পট বটে। আরেকবার আসলে এই মাঠে তাঁবু টানিয়ে রাত যাপন করবো ইনশাআল্লাহ। নিঝুমদ্বীপের স্পটগুলো অনেক দূরে দূরে অবস্হান করায় এখানে গ্রুপ করে বেড়াতে আসলে খরচ অনেক কম পড়বে। দ্বীপে সবকিছুই পাওয়া নামারবাজারে। বিকাল হয়ে এলো। এবার ফিরতে হবে।

আমরা আবার বনের ভিতর দিয়ে ফিরতে লাগলাম। দুটো খাল পাড় হতে হয়। খাল পাড় হওয়াটাও বেশ ঝুকিপূর্ণ। নীচে পড়ে গেলে কাদায় মেখে একবারে মাটির মানুষ হয়ে যেতে হবে। তার উপর আছে শ্বাসমূল। শ্বাসমূলের উপর পড়লে ভয়ানক দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আমার স্ত্রীকে কোনোমতে ধরে ধরে পাড় করেছি। অবশেষে আমরা রিসোর্টে ফিরে এলাম। এবার গোছানোর পালা। আগামী কাল আমরা নিঝুমদ্বীপ থেকে বিদায় নিবো। মনপুরা যাওয়ার জন্য জাকির ভাইয়ের নৌকা ঠিক করলাম ২২০০ টাকায়। যাত্রী মাত্র আমরা ৫ জন। ৩০-৩৫ জন লোক অনায়াসেই যেতে পারতো সে নৌকা করে। বেশী লোক হলে খরচ কম হয়। বন থেকে ফিরে দেখলাম জাকির ভাই দুটো ইলিশ মাছ এনেছে আমাদের জন্য ৬০০ টাকায়। একটা ৮০০ গ্রাম হবে আর অন্যটি ৫০০ গ্রাম। রাতে বার-বি-কিউ হবে এদুটি দিয়ে।

আসরের নামাজ পড়ে আমরা সবাই চলে গেলাম নামারবাজারে। দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি। পেট চু চু করছে। বিকালের দিকে হোটেলগুলোতে পুরি ভাজে কিন্তু ভেতরে কিছুই দেয় না। লুচির মতো। এগুলো তরকারী কিংবা মিষ্টি দিয়ে খেতে হয়। তাই খাওয়া শুরু করলাম। মহিষের দই পাওয়া যায় নিঝুমদ্বীপে। কিন্তু নিঝুমদ্বীপের দইয়ের চেয়ে মনপুরার মহিষের দই বেশ সরস। মাগরিবের আযান হলো বাজারের মসজিদে। বাচ্চাদের রিসোর্টে পাঠিয়ে দিয়ে মসজিদে চলে গেলাম। বাজারের দোকানে চা পান করে রিসোর্টে ফিরলাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে গোছানো শুরু করলাম। নীচে ইলিশ মাছের বার-বি-কিউ হচ্ছে। রাত ৯টার দিকে আমাদের খাবার রুমে পাঠিয়ে দিলো। ইলিশ মাছের বার-বি-কিউ খাওয়ার শখ ছিল। মনে করেছিলাম না জানি কি মজা। আসলে বলবার মতো তেমন কিছুই নয়। বুঝলাম বার-বি-কিউ মুরগীর মাংস দিয়েই বেশী মজা। খাওয়া শেষ করে দিলাম ঘুম।

২০ ডিসেম্বর, ২০১৮ – বৃহস্পতিবার : ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করলাম। বাচ্চাদেরকে ডেকে হয়রান। সহজে উঠতে চায় না ঘুম থেকে। একে তো শীতের সকাল তার উপর গতকাল বেশ হাটাহাটি হয়েছে। সবাই মিলে নীচের ডাইনিং রুমে চলে আসলাম। আগের দিন জাকির ভাই বলেছিল যে তার স্ত্রী আমাদের জন্য পিঠা বানাবে। চালের গুড়া দিয়ে তৈরী এক ধরনের রুটি যা মাটির পাতিলে স্যাকা দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। সাথে ছিল খেজুরের গুড় আর নারিকেল। বেশ মজা করে খেলাম। ভালবেসে কেউ যদি সামান্য কিছু দেয় তার কোনো মূল্য হয় না। বাজারে গিয়ে চা পান করে তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম। জাকির ভাইয়ের স্ত্রীর জন্য একটা চাদর কিনলো আমার স্ত্রী। ভালবাসার প্রতিদান ভালবাসা ছাড়া আর অন্য কিছু দিয়ে হয় না, এখানে টাকাটা গৌন।

নৌকা ঘাটে বাঁধা। সবাই মিলে আমাদের মালামালগুলো দুতলা থেকে নামাচ্ছে। সবুজ ভাইয়ের সাথে আমার লেন-দেন চুকিয়ে দিয়ে জাতীয় উদ্যানের পাশেই অবস্থিত নৌকায় উঠে বসলাম। বেশ বড় নৌকা। জাকির ভাই তার কথা রেখেছেন। আমরা যাবো মনপুরা দ্বীপে। নামবো মনপুরার শেষ প্রান্ত মাঝির ঘাটে। সবাই হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানালেন। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। মানুষের সাথে মিশলে নিজের অলক্ষ্যেই এক অদৃশ্য মায়ার জালে জড়িয়ে যাই আমরা। সাথে থাকলে বুঝি না কিন্তু যখন বিচ্ছেদ হয়ে যায় তখন টের পাই। নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের খাল বেয়ে আমাদের নৌকা এগিয়ে চলছে। আমরা শেষ বারের মতো নিঝুমদ্বীপকে দেখে নিচ্ছি। জীবনে হয়তো আর কোনোদিন এখানে আর আসা হবে না। বিদায় নিঝুমদ্বীপ, বিদায়।

এবার আমরা কবিরাজের চরের কাছাকাছি চলে আসলাম। কবিরাজের চরে নেমে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে ছবি তুললাম। কবিরাজের চরে এক ধরণের লম্বা ঘাস জন্মে এগুলো মহিষের খাবার এ ধরণের ঘাস প্রচুর আছে এখানে। আবার নৌকায় উঠে বসলাম। এবার আর কোনো থামাথামি নেই। সোজা চলে যাবো মনপুরায়। এখানে কোনটা সাগর আর কোনটা মেঘনা নদী বোঝার কোন উপায় নেই। সাগরে নদীতে মিলে একাকার এই নিঝুমদ্বীপ। আমাদের নৌকা এগিয়ে চলল মনপুরার পানে। পাশের চরগুলোতে অতিথি পাখির ঝাক চড়ে বেড়াচ্ছে। বেশ বড় বড় ঢেউ হচ্ছে নদীতে। বড় নৌকা থাকাতে তেমন টের পাওয়া যাচ্ছে না। আমি এবং আমার স্ত্রী নৌকার একেবারে সামনে দাড়িয়ে নৌকার দুলুনী উপভোগ করছিলাম। এই নৌকাটা নিয়েই জাকির মাঝি ও তার ভাইয়েরা সামনের বর্ষায় এক মাসের খাবার নিয়ে মাছ ধরতে যাবে সাগরের বুকে। আমরা যখন কক্সবাজার এবং কুয়াকাটায় বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন এমন নৌকা অনেক দেখেছি কিন্তু চড়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি। এবার চড়লাম। ঢেউ কাটাতে এসব নৌকার দুই প্রান্ত বেশ উচু করে বানানো হয়, ঠিক যেন ঈদের চাঁদের মতো।

ঐ তো দেখা যাচ্ছে মনপুরার মাঝির ঘাট। মনপুরা মুলত ভোলা জেলার একটি উপজেলা।  আরো ১০ মিনিট চলার পর আমাদের নৌকা মাঝির ঘাটে নোঙর ফেলল। আমরা সবাই আস্তে আস্তে নেমে পড়লাম। মাঝির ঘাটে দেখার তেমন কিছু নেই। এটা একটা ছোট্ট গ্রাম্য বাজার। বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর আমরা বাজারের মূল অংশে যেখানে রিক্সা ও হোন্ডা পাওয়া যায় সেখানে এসে পড়লাম। একটা চায়ের দোকানে ব্যাগ রেখে আমরা কিছু হাল্কা নাস্তা করলাম। নৌকার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে মাঝি ভাইদের বিদায় দিলাম। এবার আমাদের যেতে হবে মনপুরা উপজেলা শহর হাজির হাটে। ঐটাই উপজেলা সদর এবং দর্শনীয় স্পটগুলো হাজির হাটের আশে পাশেই অবস্থিত। একটা সমস্যা হলো এখানে কোনো অটোরিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। একমাত্র বাহন হোন্ডা। দুজন তাবলীগি হুজুরও দেখলাম হোন্ডা চালায়। তারাই ঠিক করলো যে তিনটি হোন্ডার একটিতে মালামালসহ একজন যাবে আর অন্য দুটিতে আমরা ৪ জন যাবো। প্রতিটি হোন্ডার ভাড়া ২০০ টাকা।

মনপুরার রাস্তা-ঘাট পাকা। মাঝে দু এক জায়গায় একটু ভাঙ্গা। আমাদের হোন্ডা মনুপুরার বুক চিরে চলে যাওয়া রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছে হাজির হাটের উদ্দেশ্যে। এই মনপুরা মেঘনার কড়াল গ্রাসের শিকার। এ পর্যন্ত দ্বীপের ১১ কিলোমিটার স্থলভূমি মেঘনার পেটে চলে গেছে। বর্ষাকালে মেঘনা এখানে ভাঙ্গা গড়ার উন্মত্ত খেলায় মেতে উঠে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে মেঘনা নদীর বিশাল জলরাশি। প্রায় ৪০-৪৫ মিনিট ছুটে চলার পর হোন্ডা চালক ভাইয়েরা আমাদের হাজীরহাট মেইনরোডে নামিয়ে দিলো। আমরা হোটেল খুজতে শুরু করলাম। বাজারের পিছনেই একটা হোটেল পেলাম। একেবারে নতুন করেছে হোটেলটি। পেছনেই একটা পুকুর এবং শান বাধানো ঘাট। অন্য যেসব হোটেল দেখেছি তার মধ্যে এটিকেই মানসম্মত মনে হয়েছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন কিন্তু রুমগুলো যেন কবুতরের খোপ। প্রতিটি রুমে দুটি করে সিঙ্গেল খাট। এটাচ্ড বাথ। ভাড়া ৬০০ টাকা। একরাত থাকবো তাই দেরী না করেই নিয়ে নিলাম।

ডাকবাংলো এবং সরকারী রেস্টহাউজে খোঁজ করেছিলাম কিন্তু সামনে নির্বাচন বিধায় সবি বুকড। রুমে গিয়ে ব্যাগ রেখে তাড়াতাড়ি গোসল সেরে নিলাম। এমন সময় সেই হোন্ডাওয়ালা হুজুররা আবার এলেন। তারা আমাদের খোজ করতে এসেছিলেন। আমরা হোটেল পেয়েছি কিনা। লোক দুটি নামাজী ও ভাল মানুষ। তাদেরকে বললাম আমাদেরকে মনপুরা দ্বীপটি ঘুরে দেখানোর জন্য। তারা রাজী হলো এবং বললাম ফোন নাম্বার রেখে যান আমরা খানা খাওয়ার পর ফোন দিলে হোটেলের সামনে চলে আসবেন। যোহরের নামাজ আদায়ের পর একটি হোটেলে গিয়ে দুপুরের খানা খেলাম। উপজেলা শহর হওয়াতে এখানকার হোটেলগুলোর মান নিঝুমদ্বীপের চেয়ে ভাল। তবে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা খুজে এখানে লাভ নেই। তাহলে না খেয়ে থাকতে হবে। ঘর থেকে বের হলে গাছ তলায় বসে খাওয়ারও অভ্যাস করতে হবে। এটাকেই বলে মানিয়ে নেয়া।

খাওয়া দাওয়ার পর আমরা হোন্ডায় চেপে বসলাম। প্রথমে গেলাম মনপুরার নতুন রাস্তা দিয়ে উচু এক ব্রীজে। দুপাশ দিয়ে লম্বালম্বি চলে গেছে নদী। মাঝখানে এই ব্রীজ। বড় বড় কার্গো মালামাল নামাচ্ছে। এখানে ব্রীজের উপর কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর মনপুরা দ্বীপের বেড়িবাধ দিয়ে সমস্ত মনপুরাটা ঘুরে দেখলাম। পথে এক জায়গায় আছরের নামাজ আদায় করলাম। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। হোন্ডায় বসে থাকতে আর ভাল লাগছে না। মাগরিবের আযান হচ্ছে মসজিদে। অবশেষে আমরা মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশানে এসে নামলাম। মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। হোন্ডাওয়ালা ভাইদের বিদায় দিয়ে ল্যান্ডিং স্টেশানে গিয়ে কিছুক্ষণ দাড়ালাম। মেঘনা নদীর উপর এই মনপুরা ল্যান্ডিং স্টেশান। এটির একেবারে শেষ প্রান্তে গেলে মনে হবে মেঘনার বুকে ভাসছেন আপনি। একটু ভয় ভয়ও লাগে। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে উত্তাল মেঘনা। এই শীত মওসুমেও স্রোতের যে গতিবেগ বর্ষায় না জানি কেমন থাকে।

স্রোতও ঢেউয়ের কারণে ল্যান্ডিং স্টেশানটির তিনটি জায়গা ডিসপ্লেইস হয়ে গেছে। তারপরও এটি যথেষ্ট শক্ত। স্টীমার, লঞ্চ, মালবাহী নৌকা নিয়মিত এখানে থামছে এবং মালামাল উঠানামা করছে। চারিদিক হাল্কা কুয়াশাচ্ছন্ন। হীমেল হাওয়ায় শরীর হীম শীতল হয়ে যাচ্ছে। তারপরও নড়তে মন চায় না এখান থেকে। মেঘনার জলের উপর চাঁদের কিরণ পড়ে ঝিকিমিকি করছে। যেন এক রাশি মুক্তা ছড়িয়ে দিয়েছে মেঘনার বুক জুড়ে। ছোটকালে এই মেঘনা নদীর কথা বইতে পড়েছি। দেখার সুযোগ হয়নি কোনোদিন। আজ আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়ার আগেই সব দেখে ফেলছে প্রযুক্তির কল্যাণে। শীতের বাতাসের তীব্রতায় বেশীক্ষণ থাকতে পারলাম না। অগত্যা হোটেলের পথে হাটা দিলাম। হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে নিতে এশার আযান পড়লো। বাজারের কাছেই মসজিদ। নামাজ সেরে সবাইকে নিয়ে হোটেলে গিয়ে রাতের খাবার খেলাম। ফিরে এসে ঘুম।

২১ ডিসেম্বর, ২০১৮ – শুক্রবার ঃ সকালে উঠে নাস্তা সেরে একটা হোন্ডা ও রিক্সায় চলে গেলাম চৌধুরী প্রজেক্ট দেখতে। চৌধুরী প্রজেক্টের সেই সৌন্দর্য্য আজ আর অবশিষ্ট নেই। মেঘনার কড়াল গ্রাসের শিকার এই প্রজেক্ট। দুপাশ দিয়ে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। আমরা প্রজেক্টের শেষ প্রান্তে গিয়ে নামলাম। মেঘনার সেকি স্রোত। এখনো নদীর প্রায় মাঝখানে একটি মৃতপ্রায় নারিকেল গাছ চৌধুরী প্রজেক্ট নদীতে বিলীন হওয়ার সাক্ষী দিচ্ছে। এক সময় হয়তো এই চৌধুরী প্রজেক্ট পুরোপুরি মেঘনার পেটে চলে যাবে। আল্লাহই ভাল জানেন। জেলেরা নদীতে ইলিশ ধরার জন্য জাল পাতছে। প্রবল শব্দে জেলেদের নৌকা উজানের পানে ধেয়ে চলছে। নদীর স্রোতের সাথে নৌকার ইঞ্জিন যেন আর পেরে উঠছে না। আমরা চৌধুরী প্রজেক্টের ভিতরে প্রবেশ করে হাটতে লাগলাম। একপাশে ঘন বন আর অপর পাশে নারিকেল গাছের সারি ও লেকের মতো পুকুর। নিঝুমদ্বীপের সর্বত্রই পাখির মেলা। বনের ভিতর হরেক রকম পাখির কিচির মিচির শুনতে পাচ্ছি। বনে বাঁদাড়ে চুপ করে থাকতে পারলে শুনতে পাওয়া যায় প্রকৃতির কথাবার্তা। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান তারা তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলে। এগুলো উপভোগ করতে হলে নিজেকে চুপ রাখতে হবে। কত কিছুর শব্দ যে আপনার কানে ভেসে আসবে। শুধু একবার কান পেতে শুনুন …

প্রায় ঘন্টা দেড়েক থাকার পর আমরা আবার ল্যান্ডিং স্টেশানে চলে গেলাম। জেলেরা ইলিশ মাছ এনে তীরে উঠছে। ঐখানেই আছে মাছের আড়ৎ এবং বরফে কল। ইলিশ মাছের ডাকের জন্য সিমেন্ট দিয়ে উচু উচু চেম্বার তৈরী করা হয়েছে। ঐখানে ইলিশ মাছ এনে ঢালছে জেলেরা আর পাইকাররা ডেকে ডেকে কিনে নিচ্ছে। তারপর বরফ দিয়ে প্যাকেট করে ষ্টীমারযোগে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে ঢাকার বিভিন্ন বাজারে। এবার ল্যান্ডিং স্টেশানের একেবারে নীচের সিঁড়ি পর্যন্ত নামলাম। মেঘনার জলে পা ভেজালো আমার মেয়ে। বাচ্চার পানি দেখতে পেলেই গোসল করতে চায়। শীতে ঠান্ডা লাগতে পারে সে চিন্তা তাদের নেই। এই যে বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দ এর রেশ থেকে যাবে বহুদিন বহুকাল। সময় স্মৃতির পাতায় এগুলো রুমন্থন হবে কোনোদিন। আর দেড়ী করলাম না। হোটেলে ফিরে গিয়ে তাড়াতাড়ি গোছগাছ করে রুমের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। এবার যাত্রা মনপুরার রামনেওয়াজ লঞ্চ ঘাট।

দুটো রিক্সা নিলাম ১০০ টাকা করে। সব জায়গাতেই কিছু মুনাফালোভী থাকবে। ওরা পর্যটক দেখলেই মনে করে আমাদের কাছে টাকার কাড়ি আছে। এদের কাছ থেকে সাবধান থাকতে হয়। ভ্রমনের সময় এসব জিনিষ খেয়াল রাখতে হয়। যাতে প্রতারিত না হতে হয়। আমাদের রিক্সা এগিয়ে চলছে রামনেওয়াজ ঘাটের দিকে। বেশ দূর বটে। একসময় আমরা রামনেওয়াজ লঞ্চ ঘটে পৌঁছে গেলাম। এবার অপেক্ষা লঞ্চের জন্য। এই রুটের বেশির ভাগ যাত্রীরা তাসরিফ লঞ্চেই যাতায়ান করে। জুমার নামাজের সময় হলো। বেশ কিছুদূর হেটে গিয়ে স্থানীয় একটি মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করলাম আমি আর আমার ছেলে সালমান। বাকীরা লঞ্চঘাটে অপেক্ষা করছে। প্রথমেই আসলো এম ভি ফারহান। এটি আগে আসে কিন্তু ঢাকায় পৌঁছে তাশরীফ এর পরে। ফারহান ৪ থাকতে থাকতেই এম ভি তাশরীফ ২ চলে এলো। ফারহান ছেড়ে গেল এবং তাসরীফ জেটিতে নোঙর করলো। আমরা গাট্টি বোচকা নিয়ে উঠে পড়লাম। মাত্র দুটি কেবিন বাকী আছে। আর সব বুকিং দেয়া। একটি ডাবল ডিলাক্স ২৫০০ টাকা আর অন্যটি ফ্যামিলি কেবিন ৩০০০টাকা।  জীবনের মতো একটা শিক্ষা নিলাম। ভবিষ্যতে যদি লঞ্চে যাতায়াত করি তাহলে আগে অবশ্যই কেবিন বুকিং দিবো। ডাবল ডিলাক্স কেবিন এটাচ্ড বাথ। সুতরাং এটিই নিয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পরেই লঞ্চ ছেড়ে দিলো। লঞ্চের একটা জিনিস ভাল লাগলো। লঞ্চ কখনো দেড়ি করে না।

সারা রাত জার্নির পর পরদিন ভোর ৫টায় লঞ্চ সদরঘাট পৌছল। আমাদের নিঝুমদ্বীপ ভ্রমণ শেষ হলো। সদরঘাট টার্মিনাল থেকে বের হয়ে দেখি মানুষ আর বাসে মিলে একাকার। এই ভোরে যেন দুপুর ১২টা বেজে গেছে। তীব্র ট্রাফিক জ্যাম। ব্যাস্ত নগরের গ্লানিময় জীবন থেকে কয়েকটা দিন অন্তত স্বস্তিতে ছিলাম।

কিভাবে যাবেনঃ

  • সদরঘাট থেকে এম ভি তাসরীফ অথবা এম ভি ফারহান। তাসরীফই ভাল। ডেকের ভাড়া ৩৫০ আর ডাবল কেবিন ১৮০০ টাকা। কেবিন নিলে আগে বুকিং দিবেন। এম ভি ফারহানের নাম্বার ০১৭৮৫৬৩০৩৬৮, ০১৭৮৫৬৩০৩৬৯।
  • নামবেন হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাটে। তারপর মালবাহী ট্রলারে বন্দরটিলা অথবা সিএনজি যোগে মুক্তারিয়া ঘাট। ট্রলারে ভাড়া নিবে ২০০-২৫০ টাকা প্রতিজন আর সিএনজি ৮০০-১০০০ টাকায় ৫ জন যেতে পারবেন। রাস্তা খারাপ। ট্রলারে গেলে আরাম হবে বেশী। হোন্ডা দিয়েও যেতে পারেন। প্রতি হোন্ডা ৩৫০-৪০০টাকা। দর দাম করে নিন। ওরা যার কাছ থেকে যেমন নিতে পারে। মুক্তারিয়া ঘাট নামার পর ট্রলার অথবা স্পীড বোটে বন্দরটিলা। স্পীডবোটে ভাড়া ৬০ টাকা প্রতিজন।
  • বন্দরটিলা নামার পর রিক্সা দিয়ে নামার বাজার ১৫০ টাকা অথবা হোন্ডায় ১২০ টাকা। নামারবাজারের আশে পাশেই সবগুলো হোটেল অবস্থিত।
  • হোটেল আছে, ভাবনার কিছু নেই। বুকিং না দিয়ে ঐখানে গিয়ে দেখে শুনে করলে খরচ কম হবে। নিঝুম রিসোর্টে থাকতে পারেন। সবুজ ভাইয়ের নাম্বার ০১৭২৪-১৪৫৮৬৪, ০১৮৪৫৫৫৮৮৯৯।
  • অবশ্যই শীতকালে যাবেন। তবে এডভেঞ্চার প্রিয় হলে বর্ষায় যেতে পারেন।
  • দয়া করে আল্লাহর ওয়াস্তে প্লাস্টিকের বোতল পলিথিন ব্যাগ অথবা পরিবেশ বিধ্বংসী কোনকিছু ফেলে আসবেন না। স্থানীয় লোকদেরকে সম্মান করবেন।
লেখক / উপস্থাপনায়: shoyab1976,
সর্বশেষ আপডেট হয়েছে: January 30, 2019

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *